নেপালের গন্ডগোলের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত ইতিহাস

নেপালের গন্ডগোলের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত

দক্ষিণ এশিয়ার একটি ছোট দেশ নেপাল, যাকে হিমালয়ের দেশ বলা হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য নেপাল বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত হলেও, রাজনৈতিক অস্থিরতা, গৃহযুদ্ধ, রাজতন্ত্র পতন, গণতন্ত্র আন্দোলন ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে দেশটি প্রায়ই আলোচনায় থাকে। আজ আমরা আলোচনা করবো নেপালের গন্ডগোল বা রাজনৈতিক সংকটের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত সম্পূর্ণ ইতিহাস।

"নেপালের গণআন্দোলনের প্রতীকী ছবি"


রাজতন্ত্রের শাসনকাল

নেপাল বহু বছর ধরে রাজতন্ত্রের অধীনে শাসিত হতো। শাহ রাজবংশ ছিল দেশটির শাসক। ১৯৫১ সালের আগে নেপাল বহির্বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল। ১৯৫১ সালে রানা শাসন পতনের পর রাজতন্ত্রের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। জনগণ ধীরে ধীরে রাজনৈতিক অধিকার দাবি করতে শুরু করে।

১৯৯০ সালের গণআন্দোলন

১৯৯০ সালে প্রথমবারের মতো রাজতন্ত্রবিরোধী গণআন্দোলন শুরু হয়। “জনআন্দোলন” নামে পরিচিত এই আন্দোলনের মাধ্যমে রাজা বিরেন্দ্র সংবিধানিক রাজতন্ত্রে সম্মত হন। দেশে বহু দলীয় গণতন্ত্র চালু হয়। কিন্তু দলগুলির মধ্যে ক্ষমতার লড়াই, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দ্রুত দেশটিকে নতুন সমস্যায় ফেলে দেয়।

মাওবাদী বিদ্রোহ (১৯৯৬ – ২০০৬)

নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ অধ্যায় হলো মাওবাদী বিদ্রোহ। ১৯৯৬ সালে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। তাদের দাবি ছিল সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্য এবং রাজতন্ত্রের অবসান। প্রায় এক দশক চলা এই গৃহযুদ্ধে প্রায় ১৭,০০০ মানুষ প্রাণ হারান। গ্রামীণ অঞ্চল থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ধীরে ধীরে পুরো দেশকে অচল করে দেয়।

২০০১ সালের রাজকীয় হত্যাকাণ্ড

২০০১ সালে নেপালে ঘটে এক ভয়াবহ ঘটনা। রাজা বিরেন্দ্র ও রানী ঐশ্বর্যসহ প্রায় পুরো রাজপরিবার এক রহস্যজনক হত্যাকাণ্ডে নিহত হন। বলা হয় রাজপুত্র দীপেন্দ্র নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গুলি চালান। এই ঘটনার পর নেপালের মানুষ রাজতন্ত্রের প্রতি আস্থা হারাতে শুরু করে। রাজা গ্যানে্ন্দ্র ক্ষমতায় আসলেও জনসমর্থন পাননি।

রাজতন্ত্রের পতন ও প্রজাতন্ত্রের জন্ম

২০০৬ সালে আবারো গণআন্দোলন শুরু হয়, যা “জনআন্দোলন-২” নামে পরিচিত। রাজা গ্যানে্ন্দ্র সংসদ ভেঙে একনায়কতন্ত্র চালু করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলির প্রবল আন্দোলনের মুখে তাকে সরে দাঁড়াতে হয়। ২০০৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয় এবং নেপাল ঘোষণা করে “ফেডারেল ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব নেপাল”।

সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে সংকট

রাজতন্ত্র পতনের পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নতুন সংবিধান রচনা। ২০১৫ সালে বহু বছরের বিতর্কের পর অবশেষে নতুন সংবিধান গৃহীত হয়। তবে এর বিরোধিতা করে মধেশি জনগোষ্ঠীসহ অনেক জাতিগোষ্ঠী। তাদের অভিযোগ ছিল, সংবিধানে তাদের অধিকার ও প্রতিনিধিত্ব সঠিকভাবে দেওয়া হয়নি। এর ফলে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে দীর্ঘদিন সংঘর্ষ, অবরোধ ও সহিংসতা চলতে থাকে।

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি

নেপালের বর্তমান রাজনীতি এখনো অস্থির। বিভিন্ন দল যেমন নেপালি কংগ্রেস, সিপিএন-ইউএমএল, মাওবাদী সেন্টার বারবার জোট করে সরকার গঠন করছে, আবার ভাঙছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকায় অর্থনীতি ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব

দীর্ঘ গন্ডগোল ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নেপালের অর্থনীতি দুর্বল হয়েছে। পর্যটন শিল্প, যা দেশের প্রধান আয়ের উৎস, অনেক সময় রাজনৈতিক সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুবসমাজের বড় অংশ বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য যেতে বাধ্য হচ্ছে। সামাজিকভাবে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন এখনো বিদ্যমান।

সাম্প্রতিক উন্নয়ন

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নেপাল চীন ও ভারতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে। দুই প্রতিবেশীর রাজনৈতিক প্রভাব নেপালের রাজনীতিতে স্পষ্ট। একইসাথে জনগণ একটি স্থিতিশীল ও উন্নত নেপালের স্বপ্ন দেখছে। যদিও এখনো রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে বিভক্তি এবং ক্ষমতার লড়াই চলছে, তবুও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে শক্তিশালী হচ্ছে।

উপসংহার

নেপালের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, দেশটি দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাজতন্ত্রের পতন, গৃহযুদ্ধ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে গেছে। যদিও বর্তমানে নেপাল একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, তবুও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এখনো পুরোপুরি আসেনি। জনগণের আশা – একদিন নেপাল হবে একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল দেশ।

গুজরাটে Suzuki Electric-car

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন